ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা ভ্রমণ গাইড: ইতিহাস, সময়সূচী ও টিপস 🏰
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের এক প্রাণবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী হলো লালবাগ কেল্লা (Lalbagh Fort)। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপত্য মুঘল আমলের গৌরব, ক্ষমতা এবং একটি করুণ প্রেমের গল্প বহন করে। এটি কেবল একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি ঢাকার ১৭শ শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। স্থানীয়ভাবে এটি কেল্লা আওরঙ্গাবাদ নামেও পরিচিত। এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ সালে, মুঘল সুবেদার প্রিন্স মুহাম্মদ আজম, যিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র ছিলেন, তার তত্ত্বাবধানে। তবে আজম শাহকে মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় এবং এর ফলে কেল্লার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি।
আজম শাহ চলে যাওয়ার পর, তার উত্তরসূরি সুবেদার শায়েস্তা খাঁ কেল্লার নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু একটি মর্মান্তিক ঘটনা কেল্লার ভাগ্য চিরতরে বদলে দেয়। শায়েস্তা খাঁর প্রিয় কন্যা পরী বিবি (ইরান দুখত)-এর হঠাৎ মৃত্যু ঘটে এই কেল্লার ভেতরেই। কন্যাশোকে কাতর শায়েস্তা খাঁ এটিকে অশুভ মনে করেন এবং ১৬৮৪ সালে কেল্লার নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রেখে দেন। আজও কেল্লার ভেতরের তিনটি প্রধান কাঠামোর মধ্যে পরী বিবির সমাধি অন্যতম আকর্ষণ। এই অসমাপ্ত মুঘল স্থাপত্যই এটিকে বিশ্বের অনন্য কেল্লাগুলোর মধ্যে স্থান দিয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন এই অসম্পূর্ণ সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে। (বাহ্যিক লিংক)
এই ভ্রমণ গাইডে আমরা লালবাগ কেল্লা ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু তুলে ধরব। কীভাবে আপনি ঢাকায় পৌঁছাবেন, কেল্লার দর্শনীয় স্থানগুলোর বিবরণ, কোথায় ভালো খাবার পাবেন এবং এই ঐতিহাসিক স্থানটি ঘুরে দেখার জন্য কিছু বিশেষ টিপস আলোচনা করা হবে। এটি শুধুমাত্র ইতিহাসের পাঠ নয়, বরং একটি সার্থক ভ্রমণের পরিকল্পনা। এই গাইডের মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন কেন এবং কখন আপনার এই মুঘল স্মৃতিস্তম্ভটি পরিদর্শন করা উচিত।
- নিকটতম বিমানবন্দর: আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (DAC) হলো প্রধান প্রবেশদ্বার। বিমানবন্দর থেকে কেল্লার দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। আপনি ট্যাক্সি বা রাইড-শেয়ারিং সার্ভিসের (যেমন: পাঠাও/উবার) মাধ্যমে সরাসরি কেল্লার আশেপাশে যেতে পারেন।
- ট্রেন/সড়ক পথে: দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা আসবেন, তারা ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন (কমলাপুর) অথবা সায়েদাবাদ, গাবতলী বা মহাখালীর যেকোনো প্রধান বাস টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারেন। পুরাতন ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য সদরঘাটগামী যেকোনো লোকাল ট্রান্সপোর্ট নিতে পারেন।
- খরচের আনুমানিক ধারণা (ঢাকা থেকে কেল্লা): বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি ভাড়া প্রায় ৬০০-১০০০ টাকা। শহরের কেন্দ্র থেকে সিএনজি বা রিকশায় ১২০-৩০০ টাকা লাগতে পারে। লোকাল বাসে ৪০-৬০ টাকা।
লালবাগ কেল্লা পরিদর্শনের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ মাস হলো সেরা সময়। এই সময়ে বাংলাদেশের আবহাওয়া শীতল ও আরামদায়ক থাকে। গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-জুন) তীব্র গরম এবং বর্ষাকালে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভারী বৃষ্টির কারণে ভ্রমণ কিছুটা কষ্টকর হতে পারে। কেল্লাটি সাধারণত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা (গ্রীষ্মকাল) এবং সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা (শীতকাল) পর্যন্ত খোলা থাকে। শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিনে সময়সূচী সামান্য পরিবর্তিত হয়, তাই যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া ভালো।
স্থানীয় মুদ্রা হলো বাংলাদেশি টাকা (BDT)। অধিকাংশ ছোট দোকানে বা কেল্লার প্রবেশপথে নগদ টাকা প্রয়োজন হবে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ও ডেবিট কার্ড বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিনের জন্য আনুমানিক বাজেট:
- কম বাজেট (Baggpacker): ১,৫০০ - ২,৫০০ টাকা (প্রতিদিন)
- মাঝারি বাজেট: ৩,৫০০ - ৭,০০০ টাকা (প্রতিদিন)
ঢাকার মতো বড় শহরে সব ধরনের আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী লাক্সারি হোটেল, বুটিক হোটেল, বাজেট হোস্টেল, এবং এয়ারবিএনবি খুঁজে নিতে পারেন।
- পুরাতন ঢাকা (Old Dhaka): যদি আপনি লালবাগ কেল্লা ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান (যেমন: আহসান মঞ্জিল, তারা মসজিদ) এর কাছাকাছি থাকতে চান, তবে পুরাতন ঢাকা বা এর সংলগ্ন এলাকা সেরা। এখানকার হোটেলগুলো সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম দামি। তবে এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা কিছুটা কম থাকতে পারে।
- গুলশান ও বনানী (Gulshan & Banani): বিলাসবহুল ও আধুনিক আবাসন চাইলে এই এলাকাগুলো আদর্শ। এখানে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, ক্যাফে এবং শপিং মল রয়েছে। কেল্লা থেকে কিছুটা দূরে হলেও এটি নিরাপদ এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।
- মতিঝিল ও পল্টন (Motijheel & Paltan): এটি বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় মাঝারি বাজেটের ব্যবসায়িক হোটেল এখানে বেশি পাওয়া যায়। কেল্লায় পৌঁছাতে এখান থেকে খুব বেশি সময় লাগে না।
বাজেট: হোটেল আল রাজ্জাক (পুরাতন ঢাকা - কেল্লার কাছাকাছি)
মাঝারি: গ্র্যান্ড প্রিন্স হোটেল (মতিঝিল - ব্যবসায়িক কেন্দ্র)
লাক্সারি: দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা (গুলশান - আধুনিক সুযোগ-সুবিধা)
আবাসন বুকিং-এর জন্য এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে পারেন।
পুরনো ঢাকার থাকার জায়গাগুলো সাধারণত তাড়াতাড়ি ভরে যায়। তাই বিশেষ করে ছুটির দিন বা পিক সিজনে ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে আগে থেকেই বুকিং করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। পুরাতন ঢাকার সরু গলিগুলোতে হেঁটে বেড়ানোর মজাই আলাদা, তবে রাত্রে চলাচলে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
যদিও লালবাগ কেল্লা অসমাপ্ত, তবুও এর ভেতরে তিনটি প্রধান স্থাপনা রয়েছে যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে:
- পরী বিবির সমাধি: এটি কেল্লার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। শায়েস্তা খাঁর প্রিয় কন্যা পরী বিবির মরদেহ এখানে সমাহিত করা হয়েছে। অপূর্ব মার্বেল পাথর এবং কারুকার্যময় গম্বুজ এই সমাধিকে মুঘল স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন বানিয়েছে।
- দেওয়ান-ই-আম (Diwan-i-Aam): এটি ছিল মুঘল সুবেদারদের বাসভবন এবং দরবার কক্ষ। এখান থেকেই প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজ পরিচালিত হতো। বর্তমানে এখানে মুঘল আমলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রদর্শন করা হয়।
- হম্মাম ও টয়লেট (Hammam & Toilet): এটি মূলত সুবেদারের স্নানাগার ও শৌচাগার। এখানে পানি গরম করার উন্নত ব্যবস্থা ছিল, যা সেই যুগের প্রযুক্তির দারুণ উদাহরণ। এখানে একটি ছোট জাদুঘরও রয়েছে।
কেল্লা পরিদর্শনের পর আপনি পুরাতন ঢাকার আরও কিছু ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখতে পারেন:
- আহসান মঞ্জিল (Ahsan Manzil): এটি ছিল ঢাকার নবাবদের সরকারি বাসভবন। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই গোলাপী প্রাসাদটি কেল্লা থেকে খুব কাছে।
- তারা মসজিদ (Star Mosque): এর মনকাড়া মোজাইক ও তারার মতো ডিজাইন একে এক বিশেষ সৌন্দর্য দিয়েছে।
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (Dhaka University): কেল্লা থেকে একটু দূরে হলেও এটিকে "প্রাচ্যের অক্সফোর্ড" বলা হয়। এর ঐতিহাসিক ভবন ও টিএসসি এলাকা দেখতে পারেন।
টিকেট টিপস: কেল্লার টিকিট কাউন্টারে লম্বা লাইন এড়াতে ছুটির দিন বাদে অন্য দিন সকালে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভেতরে গাইড পাওয়া যায়, যারা অল্প টাকায় কেল্লার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারে।
পুরাতন ঢাকা মানেই খাবারের স্বর্গ! লালবাগ কেল্লা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্থানীয় খাবার চেখে দেখা ছাড়া অসম্পূর্ণ। এখানকার মুঘল ঐতিহ্য খাবারের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে।
- কাচ্চি বিরিয়ানি (Kacchi Biryani): ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। বাসমতি চাল, আলুর সঙ্গে মাংসের নিখুঁত মিশ্রণ আপনার মন জয় করবে।
- তেহারি ও মোরগ পোলাও: বিরিয়ানির মতোই জনপ্রিয় এই খাবারগুলোও পুরাতন ঢাকায় বিশেষভাবে বিখ্যাত।
- বাকরখানি (Bakarkhani): এটি এক ধরনের পুরু, মশলাযুক্ত বিস্কিট। গরম চায়ের সঙ্গে বাকরখানি এখানকার ঐতিহ্যবাহী জলখাবার।
- ফালুদা ও বোরহানি: মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে ফালুদা (আইসক্রিম, নুডলস ও ফল দিয়ে তৈরি) খুবই বিখ্যাত। আর বোরহানি হলো টক দই দিয়ে তৈরি একটি পানীয়, যা ভারী খাবারের পর হজমে সহায়তা করে।
ঐতিহ্যবাহী: হাজির বিরিয়ানি (নবাবপুর রোড), ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি
মিষ্টি: বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডার, আল-রাজ্জাক
স্ট্রিট ফুড: চকবাজার বা বকশীবাজার এলাকার স্থানীয় ফাস্ট ফুড ও চটপটির দোকানগুলো দারুণ জনপ্রিয়।
মনে রাখবেন, পুরাতন ঢাকার রাস্তার খাবার খুবই সুস্বাদু হলেও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কিছুটা সতর্ক থাকতে হবে। সবসময় বোতলজাত পানীয় জল পান করুন। আর অবশ্যই দরদাম করতে ভুলবেন না, বিশেষ করে যদি স্থানীয় বাজার থেকে কিছু কিনতে চান।
ঢাকা একটি বিশাল এবং যানজটপূর্ণ শহর, তাই আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মসৃণ করার জন্য সঠিক পরিবহন মাধ্যম নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। লালবাগ কেল্লা পুরাতন ঢাকায় অবস্থিত, যেখানে গাড়ি বা বড় বাস প্রবেশ করা কঠিন।
- রিকশা (Rickshaw): পুরাতন ঢাকার সরু গলিগুলোতে ঘোরার জন্য রিকশা হলো সেরা এবং ঐতিহ্যবাহী মাধ্যম। স্বল্প দূরত্বে এটি সবচেয়ে উপযোগী। তবে ভাড়ার ক্ষেত্রে আগে থেকেই দরদাম করে নেওয়া ভালো।
- সিএনজি অটোরিকশা (CNG Auto-rickshaw): মাঝারি দূরত্বের জন্য সিএনজি একটি ভালো বিকল্প। মিটারে চললেও অনেক চালক মিটারে যেতে চান না, সেক্ষেত্রে দরদাম আবশ্যক।
- রাইড-শেয়ারিং অ্যাপস (Ride-Sharing Apps): ঢাকা শহরে Uber, Pathao, Obhai-এর মতো অ্যাপগুলো খুবই জনপ্রিয়। আপনি গাড়ি বা মোটরবাইক ভাড়া নিতে পারেন। এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ঝামেলামুক্ত উপায়।
- লোকাল বাস: দূরপাল্লার যাতায়াতের জন্য বাস ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে বাসে ভিড় এবং যানজট বেশি হয়। পর্যটকদের জন্য এটি কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ টিপ: লালবাগ কেল্লায় যাওয়ার পথে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করা আবশ্যক। যানজটের কারণে পৌঁছানোর সময় পরিবর্তন হতে পারে, তাই হাতে অতিরিক্ত সময় নিয়ে বের হন। পুরাতন ঢাকার রাস্তাগুলো প্রায়শই ঘনবসতিপূর্ণ এবং সরু হয়।
📌 আরো পড়ুন (Read More)
গুগল ম্যাপ শেয়ার কোড: লালবাগ কেল্লার সঠিক অবস্থান নিচে এমবেড করা হলো। এটি আপনাকে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে লালবাগ কেল্লায় যাওয়ার প্রক্রিয়া খুবই সহজ। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ম্যাপের নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
- ১. আপনার অবস্থান চিহ্নিত করুন: ম্যাপ খোলার পর "Your Location" আইকনে ক্লিক করে আপনার বর্তমান অবস্থান চিহ্নিত করুন।
- ২. "Directions" অপশনটি বাছুন: গন্তব্য (লালবাগ কেল্লা) নির্বাচন করে "Directions" বাটনে ক্লিক করুন।
- ৩. পরিবহন মাধ্যম নির্বাচন করুন: বাস (Bus), গাড়ি (Car), মোটরবাইক (Motorbike) বা হাঁটার (Walking) আইকনগুলোর মধ্যে আপনার পছন্দের মাধ্যমটি বেছে নিন। যদি পুরাতন ঢাকার কাছাকাছি থাকেন, তাহলে হেঁটে যাওয়া বা রিকশা নেওয়া সবচেয়ে ভালো রুট দেখাবে।
- ৪. রুট অনুসরণ করুন: ম্যাপে প্রদর্শিত নীল রঙের রুটটি ধরে এগিয়ে চলুন। পুরাতন ঢাকার সরু গলিগুলোতে ম্যাপ মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত করতে পারে, সেক্ষেত্রে স্থানীয়দের সহায়তা নিতে পারেন।
লালবাগ কেল্লা ভ্রমণ কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে দেখা নয়, এটি প্রায় ৩০০ বছর আগের মুঘল আমলের একটি জীবনযাত্রা ও আবেগের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। কেল্লার প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল শায়েস্তা খাঁর ক্ষমতা, প্রিন্স আজম শাহের স্বপ্ন এবং পরী বিবির ট্র্যাজেডির গল্প শোনায়। অসমাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও, কেল্লার স্থাপত্যশৈলী এবং এর বিশাল এলাকা এটিকে ঢাকার অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
এই পুরো গাইডে আমরা আপনাকে লালবাগ কেল্লায় একটি সফল ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সরবরাহ করেছি। আমরা দেখেছি যে কেল্লা ভ্রমণের সেরা সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ মাস, যখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। ঢাকা শহরে পৌঁছানোর জন্য বিমান, ট্রেন বা সড়কপথ ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং পুরাতন ঢাকার কাছেই তুলনামূলক কম খরচে এবং গুলশান-বনানীতে বিলাসবহুল আবাসন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যের স্বাদ পেতে রিকশা ব্যবহার করা বা স্থানীয়দের মতো হেঁটে ঘোরাটাই আসল অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
ভ্রমণকারীদের জন্য মনে রাখা জরুরি কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস হলো: কেল্লার ভেতরের প্রতিটি স্থাপনা, বিশেষ করে পরী বিবির সমাধি এবং দেওয়ান-ই-আম মনোযোগ দিয়ে দেখা। ভেতরে স্থাপিত জাদুঘরটি আপনাকে মুঘল আমলের বিভিন্ন সামগ্রী সম্পর্কে ধারণা দেবে। কেল্লা পরিদর্শন শেষে পুরাতন ঢাকার বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি এবং মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুলবেন না। এটি নিঃসন্দেহে আপনার ভ্রমণের সেরা অংশ হবে।
নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীষ্মকালে সানগ্লাস ও পর্যাপ্ত জল পান করা আবশ্যক। এছাড়া, স্থানীয়দের প্রতি সম্মান দেখানো এবং কেল্লার ঐতিহাসিক মূল্য বজায় রাখার জন্য নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রত্যেক পর্যটকের দায়িত্ব। এই স্থাপত্যটি বাংলাদেশের জাতীয় গর্বের প্রতীক।
লালবাগ কেল্লা-র বিশাল সবুজ প্রাঙ্গণ আপনাকে শহরের কোলাহল থেকে দূরে একটি শান্ত, ঐতিহাসিক পরিবেশে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ দেবে। আপনি যখন কেল্লার উঁচু ফটক দিয়ে প্রবেশ করবেন, তখন মনে হবে যেন আপনি সময়ের পথ ধরে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গেছেন। এই অসমাপ্ত মুঘল স্বপ্নটি আজও মানুষকে মুগ্ধ করে, যা প্রমাণ করে যে কিছু গল্প অসম্পূর্ণ থাকা অবস্থাতেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর। আশা করি এই ভ্রমণ গাইডটি আপনার লালবাগ কেল্লা ভ্রমণকে আরও সহজ, আনন্দময় এবং শিক্ষণীয় করে তুলবে।
৯. প্রশ্ন ও উত্তর (Q&A) ❓
উত্তর: না। সাধারণত কেল্লাটি রোববার পূর্ণ দিবস এবং সোমবার অর্ধ দিবস বন্ধ থাকে। বাকি দিনগুলো খোলা থাকে।
উত্তর: সাধারণত ১.৫ থেকে ২ ঘণ্টা সময় লাগে পুরো কেল্লা ঘুরে দেখতে এবং ভেতরের জাদুঘরটি পরিদর্শন করতে।
উত্তর: হ্যাঁ, পরী বিবির সমাধি কেল্লার প্রধান আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি এবং এটি দর্শনের জন্য খোলা থাকে।
উত্তর: বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশমূল্য ৫০০ টাকা (সার্কভুক্ত দেশের জন্য ৩০০ টাকা)।
উত্তর: পুরাতন ঢাকার চকবাজার, বকশীবাজার এবং সদরঘাট এলাকায় প্রচুর ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু খাবারের দোকান পাওয়া যায়।
উত্তর: সাধারণত ব্যক্তিগত ছবি তোলার জন্য কোনো অতিরিক্ত ফি লাগে না। তবে পেশাদার ফটোগ্রাফি বা ভিডিওগ্রাফির জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি এবং ফি প্রয়োজন হতে পারে।
উত্তর: লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন মুঘল সুবেদার প্রিন্স মুহাম্মদ আজম।
উত্তর: সুবেদার শায়েস্তা খাঁ-এর কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর কারণে তিনি কেল্লাটিকে অশুভ মনে করেন এবং নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত রেখে দেন।
উত্তর: হ্যাঁ, প্রধান ফটকের আশেপাশে বেসরকারি গাইড পাওয়া যায়, যারা অল্প টাকার বিনিময়ে কেল্লার ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য দেন।
উত্তর: হ্যাঁ, নিকটেই রয়েছে আহসান মঞ্জিল, তারা মসজিদ এবং সাত গম্বুজ মসজিদ।
উত্তর: শীতকালে (অক্টোবর থেকে মার্চ) কেল্লা সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে।